গীবত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কুরআন ও হাদিস থেকে

গীবত কী ও কাকে বলে এবং এর পরিনতি কেমন ?
গীবত হলো ইসলামে জঘন্যতম কাজ গুলোর মধ্যে অন্যতম । একজন মানুষ যেমন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ফলে তার জীবন কঠিন হয়ে পরে । ঠিক তেমনি সমাজে যখন গীবত এর প্রচলন হয় তখন সমাজ ব্যবস্থাও কঠিন হয়ে পরে । কারন মানুষ শান্তিতে বসবাস করার জন্য একটি সুন্দর পরিবেশ এর আশা করে থাকে । কিন্তু গীবতের ফলে সমাজে সবসময় মানুষ মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় যার ফলে সে চাইলেও শান্তিতে বসবাস করতে পারে না ।
আমরা গীবত সম্পর্কে নীচে বিস্তারিত আলোচনা করবো তবে তার আগে চলুন দেখি গীবত সম্পর্কে কুরআন ও হাদিস কী বলে ?
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱجۡتَنِبُواْ كَثِيرٗا مِّنَ ٱلظَّنِّ إِنَّ بَعۡضَ ٱلظَّنِّ إِثۡمٞۖ وَلَا تَجَسَّسُواْ وَلَا يَغۡتَب بَّعۡضُكُم بَعۡضًاۚ أَيُحِبُّ أَحَدُكُمۡ أَن يَأۡكُلَ لَحۡمَ أَخِيهِ مَيۡتٗا فَكَرِهۡتُمُوهُۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ تَوَّابٞ رَّحِيمٞ
হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিকাংশ অনুমান হতে দূরে থাক; কারণ কোনো কোনো অনুমান পাপ এবং তোমরা একে অন্যের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না এবং একে অন্যের গীবত করো না [১]। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে চাইবে [২]? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণ্যই মনে কর। আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; নিশ্চয় আল্লাহ্ তওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু। সূরা হুজরাত – ১২
وَيۡلٞ لِّكُلِّ هُمَزَةٖ لُّمَزَةٍ
দুর্ভোগ প্রত্যেকের, যে পিছনে ও সামনে লোকের নিন্দা করে সূরা হুমাযাহ – ১
عَنْ أَبِي بَرْزَةَ الْأَسْلَمِيِّ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَا مَعْشَرَ مَنْ آمَنَ بِلِسَانِهِ، وَلَمْ يَدْخُلِ الْإِيمَانُ قَلْبَهُ، لَا تَغْتَابُوا الْمُسْلِمِينَ، وَلَا تَتَّبِعُوا عَوْرَاتِهِمْ، فَإِنَّهُ مَنِ اتَّبَعَ عَوْرَاتِهِمْ يَتَّبِعُ اللَّهُ عَوْرَتَهُ، وَمَنْ يَتَّبِعِ اللَّهُ عَوْرَتَهُ يَفْضَحْهُ فِي بَيْتِهِ
আবু দাউদ – ৪৮৮০। আবূ বারযাহ আল-আসলামী (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হে সেসব লোক যারা কেবল মুখেই ঈমান এনেছে কিন্তু ঈমান অন্তরে প্রবেশ করেনি! তোমরা মুসলিমদের গীবত করবে না ও দোষত্রুটি তালাশ করবে না। কারণ যারা তাদের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়াবে আল্লাহও তাদের দোষত্রুটি খুঁজবেন। আর আল্লাহ কারো দোষত্রুটি তালাশ করলে তাকে তার তার ঘরের মধ্যেই অপদস্থ করে ছাড়বেন।[1]
عَنْ مُعَاوِيَةَ، قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: إِنَّكَ إِنِ اتَّبَعْتَ عَوْرَاتِ النَّاسِ أَفْسَدْتَهُمْ، أَوْ كِدْتَ أَنْ تُفْسِدَهُمْ
মু’আবিয়া (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ তুমি যদি মানুষের গোপন দোষ তালাশ করো তাহলে তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বা ক্ষতির সীমানায় পৌঁছে দিবে । আবু দাউদ – ৪৮৮৮
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ” أَتَدْرُونَ مَا الْغِيبَةُ ” . قَالُوا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ . قَالَ ” ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ ” . قِيلَ أَفَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ فِي أَخِي مَا أَقُولُ قَالَ ” إِنْ كَانَ فِيهِ مَا تَقُولُ فَقَدِ اغْتَبْتَهُ وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيهِ فَقَدْ بَهَتَّهُ ”
সহিত মুসলিম – ৬৪৮৭-(৭০/২৫৮৯) ইয়াহইয়া ইবনু আইয়্যুব, কুতাইবাহ ও ইবনু হুজর (রহঃ) ….. আবু হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা কি জান, গীবত কী জিনিস? তারা বললেন, আল্লাহ ও তার রসূলই অধিক জ্ঞাত। তিনি বললেন, (গীবাত হলো) তোমার ভাইয়ের সম্পর্কে এমন কিছু আলোচনা করা, যা সে অপছন্দ করে। প্রশ্ন করা হলো, আমি যা বলছি তা যদি আমার ভাই এর মধ্যে বাস্তবিকই থেকে থাকে তবে আপনি কি বলেন? তিনি বললেন, তুমি তার সম্পর্কে যা বলছ তা যদি তার মধ্যে প্রকৃতই থেকে থাকে তাহলেই তুমি তার গীবত করলে। আর যদি তা তার মধ্যে না থাকে তাহলে তো তুমি তার প্রতি অপবাদ আরোপ করলে। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৩৫৭, ইসলামিক সেন্টার ৬৪০৭)
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَمَّا عُرِجَ بِي مَرَرْتُ بِقَوْمٍ لَهُمْ أَظْفَارٌ مِنْ نُحَاسٍ يَخْمُشُونَ وُجُوهَهُمْ وَصُدُورَهُمْ، فَقُلْتُ: مَنْ هَؤُلَاءِ يَا جِبْرِيلُ، قَالَ: هَؤُلَاءِ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ لُحُومَ النَّاسِ، وَيَقَعُونَ فِي أَعْرَاضِهِمْ
৪৮৭৮। আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মি’রাজের রাতে আমি এমন এক কওমের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলাম যাদের নখগুলো তামার তৈরী এবং তা দিয়ে তারা অনবরত তাদের মুখমণ্ডলে ও বুকে আচড় মারছে। আমি বললাম, হে জিবরীল! এরা কারা? তিনি বললেন, এরা সেসব লোক যারা মানুষের মাংস খেতো (গীবত করতো) এবং তাদের মানসম্মানে আঘাত হানতো।[1] আবু দাউদ – ৪৮৭৮
عَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ “ مَنْ رَدَّ عَنْ عِرْضِ أَخِيهِ رَدَّ اللَّهُ عَنْ وَجْهِهِ النَّارَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ”
তিরমিজী – ১৯৩১। আবূদ দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে লোক তার কোন ভাইয়ের মান-সম্মানের উপর আঘাত প্রতিরোধ করে, কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তা’আলা তার মুখমণ্ডল হতে জাহান্নামের আগুন প্রতিরোধ করবেন।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم “ مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلاَ يُؤْذِ جَارَهُ، وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ، وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ ”.
বুখারী – ৬০১৮. আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে জ্বালাতন না করে। যে আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে। যে লোক আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে, অথবা চুপ থাকে। [৫১৮৫; মুসলিম ১/১৯, হাঃ ৪৭, আহমাদ ৭৬৩০] (আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫৮৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪৮০)
গীবতকারী মুসলিম যদি গীবত থেকে তওবা না করে মারা যায়, তবে তিনি প্রথম সুযোগে জান্নাতে যেতে পারবে না; বরং তাকে গীবতের শাস্তি পাওয়ার জন্য প্রথমে জাহান্নামে প্রবেশ করতে হবে। যারা মুমিনদের প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেয় এবং তাদের নিন্দা করে, ক্বিয়ামতের দিন তাদেরকে জাহান্নামীদের রক্ত-পুঁজ খাওয়ানো হবে। সাহ্ল ইবনে মু‘আয (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ رَمَى مُسْلِمًا بِشَيْءٍ يُرِيدُ شَيْنَهُ بِهِ، حَبَسَهُ اللهُ عَلَى جِسْرِ جَهَنَّمَ حَتَّى يَخْرُجَ مِمَّا قَالَ، ‘যে ব্যক্তি কোন মুসলিমকে অপমান করার উদ্দেশ্যে তাকে দোষারোপ করবে, মহান আল্লাহ তাকে জাহান্নামের সেতুর উপরে আটক করবেন, যতক্ষণ না তার কৃত কর্মের ক্ষতিপূরণ হয়’।[42] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ قَالَ فِي مُؤْمِنٍ مَا لَيْسَ فِيهِ أَسْكَنَهُ اللهُ رَدْغَةَ الْخَبَالِ حَتَّى يَخْرُجَ مِمَّا قَالَ، ‘যে ব্যক্তি ঈমানদার লোকের এমন দোষ বলে বেড়ায় যা তার মধ্যে নেই, আল্লাহ তাকে জাহান্নামীদের (দেহ নিঃসৃত) রক্ত-পুঁজের মাঝে বসবাস করাবেন। যতক্ষণ না সে তার কথা (গীবত) থেকে ফিরে আসবে’।[43] আশরাফ বলেন, গীবত থেকে ফিরে আসার অর্থ হ’ল শাস্তি পরিপূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত গীবতকারী জাহান্নামের আযাব থেকে মুক্তি পাবে না। কালেক্টেড মাসিক আত তাহরিক
إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الْحَدِيثِ وَلَا تَحَسَّسُوا وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا تَحَاسَدُوا وَلَا تَدَابَرُوا وَلَا تَبَاغَضُوا وَكُونُوا عِبَادَ اللَّهِ إِخْوَانًا
“খবরদার! তোমরা অবশ্যই অনুমান-ধারণা থেকে বহুদূরে থাকবে। কারণ অনুমান ধারণাই সবচেয়ে বড় মিথ্যা। এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় জানার চেষ্টা করবে না, গোপন দোষ সন্ধান করবে না, পরস্পরে হিংসা করবে না, পরস্পরে বিদ্বেষে লিপ্ত হবে না এবং পরস্পরে শত্রুতা ও সম্পর্কচেছদ করবে না। তোমরা পরস্পরে ভাইভাই আল্লাহর বান্দা হয়ে যাও।”[2] সহীহুল বুখারী ৩/১০০৯, ৫/১৯৭৬, ২২৫৩, ৬/২৪৭৪; সহীহ মুসলিম ৪/১৯৮৫।
الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لَا يَظْلِمُهُ وَلَا يُسْلِمُهُ وَمَنْ كَانَ فِي حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللَّهُ فِي حَاجَتِهِ وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللَّهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرُبَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
“মুসলিম মুসলিমের ভাই। একজন আরেকজনকে জুলুম করে না এবং বিপদে পরিত্যাগ করে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন মেটাতে ব্যস্ত থাকবে আল্লাহ তার প্রয়োজন মেটাতে থাকবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের কষ্ট-বিপদ দূর করবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার বিপদ দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ গোপন করবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন করবেন।”[4] বুখারী আস-সহীহ ২/৮৬২; মুসলিম আস-সহীহ ৪/১৯৯৬, ২০৭৪।