জাকাত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কুরআন ও হাদিস থেকে

ভূমিকা :
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ,
সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ্ তায়ালার জন্য যিনি ধনীর সম্পদের মধ্যে দরিদ্রের হক রেখে ধনীর সম্পদকে পবিত্র করেছেন এবং দরিদ্রের দারিদ্রকে বিমোচন করেছেন যাকাতের মাধ্যমে।
লক্ষ কোটি দরুদ ও সালাম দো-জাহানের সর্দার আল্লাহ তায়ালার মনোনীত শ্রেষ্ট পয়গম্বর হযরত মুহাম্মদ সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর যিনি বিশ্বের বুকে ইনসাফকে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন ।
আজকে আমরা যাকাত সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো ইনশাআল্লাহ ।
আমাদের জানা আছে, যাকাত ইসলামের অন্যতম আবশ্যক এক ফরজ ইবাদত ও ৩য় স্তম্ভ।
কুরআনে ৮২ যায়গায় সরাসরি যাকাত দানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে এমনকি কুরআনের ১৯ টি সূরায় ও ২৯ টি আয়াতে যাকাত শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায় । *যাকাত কোন অনুগ্রহের দান নয় বরং তা হচ্ছে দরিদ্রের সুনির্ধারিত প্রাপ্য ।
মু’আয ইবন জাবাল (রা:) থেকে বর্ণিত নবী করীম সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ‘যাকাত তোমাদের ধনীদের থেকে গ্রহণ করা হবে এবং তোমাদের অভাবগ্রস্থদের হাতে তুলে দেয়া হবে ।
সহিহ আল বুখারী , খন্ড নং. ২ হাদিস নং. ১৩৩১ পৃষ্ঠা নং. ৫০৫
সহিহ আল মুসলিম, খন্ড নং. ১ হাদিস নং. ২৯ পৃষ্ঠা নং. ৫০
যাকাতের পরিচয়:
আভিধানিক অর্থে,
যাকাত শব্দটি আরবী, অর্থ পবিত্র করণ, বেড়ে যাওয়া , বরকতময়, ইত্যাদি ।
পারিভাষিক অর্থে,
’আল্লাহ্ তায়ালার সন্তষ্টির উদ্দেশ্যে হাশিমী এবং তাদের আজাদকৃত গোলাম ব্যতীত যে কোনো অভাবী মুসলিমকে শরী’আত নির্ধারিত হারে সম্পদের নিঃস্বার্থ মালিক বানিয়ে দেওয়া’
মূলত,
নিজের ধন-সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ গরীব-মিসকীন ও অভাবী লোকদের মধ্যে বন্টন করাকে যাকাত বলা হয়।
মোটকথা,
যাকাত সামগ্রীকভাবে সমাজের রন্ধ্র থেকে অন্যায় আবিলতা দূর করে সমাজকে সুষ্ঠ, সুন্দর, বিকশিত ও সু-সংহত করে তোলে।
বর্তমান বিশ্বের, বিশেষ করে আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে যাকাত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হওয়া অত্যন্ত জরুরী।
যাকাতের লাভ ও গুরুত্ব:
১. অন্তরে পরিশুদ্ধি অর্জন হয়:
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
‘তাদের সম্পদ থেকে সাদকা (যাকাত) গ্রহণ করুন । এর দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র করবেন এবং পরিশোধিত করবেন ।
সূরা তওবা : আয়াত নং. ১০৩
২. পরকালের সঞ্চয় :
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
’তোমরা সালাত কায়েম কর ও যাকাত আদায় কর ও তোমরা উত্তম কাজের জন্য যা কিছু পূর্বে প্রেরণ করবে আল্লাহর নিকট তা পাবে’
৩.যাকাত সম্পদ বৃদ্ধি করেঃ
যাকাত দিলে মানুষের সম্পদ কমে না, বরং বাড়ে। যারা গভীর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর নির্দেশ মতো তাঁর পথে ব্যয় করেন, পরম করুনাময় আল্লাহ এর বিনিময়ে কেবল পরকালে নয়, দুনিয়াতেও ব্যাপক বরকত, স্বচ্ছলতা ও উন্নতি দান করেন।
যেমন আলাহ বলেন-“তোমরা যে সূদ দিয়ে থাক, মানুষের সম্পদে বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য তা মূলতঃ আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি পায় না। আর তোমরা যে যাকাত দিয়ে থাক আল্লাহর সন্তষ্টি কামনা করে (তাই বৃদ্ধি পায়) এবং তারাই বহুগুণ সম্পদ প্রাপ্ত ।” সূরা রুম-৩৯
অন্যত্র বলা হয়েছে-“যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে, তাদের খরচের দৃষ্টান্ত হচ্ছে একটি শষ্য বীজের মতো, যে বীজ থেকে সাতটি শীষ বের হয় এবং প্রত্যেকটি শীষে হয় একশটি দানা। আলাহ যার আমলকে চান এভাবেই বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহতো সীমাহীন ব্যাপকতার অধিকারী, জ্ঞানী।” সূরা বাকারা-২৬১
যাকাতযোগ্য সম্পদ :
প্রধানতঃ নিম্নোক্ত পাঁচ প্রকার সম্পদের যাকাত প্রদান করা ফরয।
যেমনঃ
(১) বিচরণশীল উট, গরু, ছাগল ইত্যাদি গৃহপালিত পশু,
(২) স্বর্ণ রৌপ্য,
(৩) নগদ টাকা,
(৪) ব্যবসা বা বিক্রয়ের জন্য রক্ষিত দ্রব্য ও
(৫) কৃষি উৎপাদন বা ফল ও ফসল।
যাদের উপর যাকাত ফরজ :
সালাত ফরজ হবার জন্যে যেমন কিছু শর্ত আছে, তেমনি যাকাত ফরজ হবার জন্যেও কিছু শর্ত আছে। শরীয়াহ বিশেষজ্ঞদের মতে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিরই উপর যাকাত ফরজ, যাদের মধ্যে নিম্নোক্ত শর্তাবলী পাওয়া যায়-
১.মুসলিম ২. স্বাধীন ৩. আকেল হওয়া ৪. বালেগ হওয়া ৫. নিসাব পরিমান সম্পদ থাকা ৬. পূর্ণাঙ্গ মালিকানা থাকা ৭. এক বছর অতিবাহিত হওয়া।
যারা যাকাত পাবেঃ
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যাকাত কাদের প্রাপ্ত এবং যাকাতের অর্থ কাদেরকে বন্টন করে দিতে হবে সে সম্পর্কে সু-স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন-“এসব সদাকাতো অর্থাৎ যাকাত কেবল নিস্ব, অভাবগ্রস্থ ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, ঋণ ভারাক্রান্তদের, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” সূরা তাওবা-৬০
উপরের আয়াত হতে আটটি খাতে যাকাতের অর্থ ব্যবহারের জন্যে সু-স্পষ্টভাবে নির্দেশ পাওয়া যায়।
সেগুলি হচ্ছে-
১. দরিদ্র্য জনসাধারণ ২. অভাবী ব্যক্তি ৩. যে সকল ব্যক্তি/কর্মচারী যাকাত আদায়ে নিযুক্ত রয়েছেন ৪. নও মুসলিম ৫. ক্রীতদাস বা গোলাম মুক্তি ৬. ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি ৭. আল্লাহর পথে মুজাহীদ এবং ৮. মুসাফির।
যাকাত আদায় না করার কঠোর শাস্তি:
আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, ‘আর আল্লাহ তায়ালা নিজ অনুগ্রহে যা তাদেরকে দিয়েছেন তাতে যারা কৃপণতা করে, তাদের জন্য তা মঙ্গল এ যেন তারা কিছুতেই মনে না করে । না , এটা তাদের জন্য অমঙ্গল । যাতে তারা কৃপণতা করবে কিয়ামতের দিন তাই তাদের গলায় বেড়ি হবে’
সূরা আলে ইমরান সূরা নং. ৩ আয়াত নং. ১৮০
দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাতের ভূমিকাঃ
যাকাতের অন্যতম অর্থনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামী সমাজ হতে দারিদ্রতা দূর করা। দারিদ্র্যতা মানবতার দুশমন। ক্ষেত্র বিশেষে তা কুফরী পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। যে কোন সমাজ ও দেশের এটা সবচেয়ে জটিল ও তীব্র সমস্যা। সমাজে হতাশা ও বঞ্চনার অনুভূতি সৃষ্টি হয় দারিদ্র্যতার ফলে। পরিনামে দেখা দেয় সামাজিক সংঘাত। বহু সময়ে রাজনৈতিক অভ্যুত্থান পর্যন্ত ঘটে। অধিকাংশ অপরাধই সচরাচর ঘটে দারিদ্রতার জন্য। এ সমস্যাগুলির প্রতিবিধান করার জন্যে যাকাত ইসলামের অন্যতম মুখ্য হাতিয়ার। যে আট শ্র্রেণীর লোকের কথা পূর্বেই উলেখ করা হয়েছে, যাকাত লাভের ফলে তাদের দিনগুলি আনন্দ ও নিরাপত্তার হতে পারে। যাকাত যথাযথভাবে আদায় ও পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা হলে আজকের দিনেও এর মাধ্যমে দারিদ্রতা দূর করা সম্ভব।
বেশিরভাগ লোকই মনে করেন দরিদ্র জনগনের অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে চাই সরকারী সাহায্য, নয়তো বিদেশী অনুদান। কিন্ত একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যেতো, এ দেশে যে বিপুল পরিমান অর্থ যাকাতের মাধ্যমে বিতরণ করা হয় তার সুষ্ঠু, সংগঠিত ও পরিকল্পিত ব্যবহার হলে এসব দরিদ্র লোকদের অবস্থার পরিবর্তন করা খুবই সম্ভব।
যাকাতের অর্থ দিয়ে বিভিন্নভাবে মানবসম্পদ উন্নয়নমূলক কাজ করা যায়, তার মধ্যে অন্যতম হলো দ্বীনি শিক্ষা অর্জনে সহযোগিতাঃ
প্রস্তাবনা:
যাকাত ব্যবস্থার পরিকল্পিত বণ্টন না হওয়ার কারনে দারিদ্র বিমোচন কাঙ্ক্ষিত মানের হচ্ছে না । নিম্নে কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করা হল:
এক. যাকাত ফান্ডকে আরও বেগবান করার জন্য সমাজের ধনীদেরকে এগিয়ে আসতে হবে ।
দুই. সরকারী অন্যান্য সেক্টরের ন্যায় এ সেক্টরকেও যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে যাকাত ফান্ডের সফল বাস্তবায়নের লক্ষে বিশ্বস্ত জনবল অবকাঠামো বৃদ্ধি করতে হবে ।
তিন. যাকাত আদায় করার জন্য ইসলামী ফিকহ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বোর্ড গঠন করতে হবে ।
চার. দারিদ্র বিমোচনের লক্ষে মাষ্টার প্লান নিয়ে কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে ।
পাঁচ. শরী’আ সুপারভাইজরি কমিটি, দেশের শীর্ষস্থানীয় আলিম-ওলামা, ইসলামী গবেষক ও স্কলারদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে । তারা ইসলামী শরী’আতের প্রয়োগ ও বিধি-নিষেধ সম্পর্কে যাকাত বোর্ডকে গাইড করবেন ।
যা ইতোমধ্যেই সরকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর মাধ্যমে উপরোক্ত প্রস্তাবনা বাস্তবায়নে বহুমুখি কার্যাক্রম গ্রহণ করেছে যা সত্তিই প্রশংসনীয়, দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর ।
উপসংহার:
পরিশেষে আমি মনে করি এ কথাই বাস্তব যে
যাকাত ধনী-গরীবের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় করে। যাকাত আদায়ের ফলে অন্তর পরিস্কার ও পরিশুদ্ধ হয় এবং কৃপণতার মত ঘৃণ্য চরিত্র থেকে মুক্তিলাভ করা যায়। যাকাত ব্যক্তিকে দানশীল, মহানুভব এবং অভাবে জর্জরিত বঞ্চিত মানবতার প্রতি দয়া পরবশ হতে অভ্যস্ত করে। আল্লাহর পক্ষ থেকে বরকত ও বিনিময় লাভ করা যায়। গোনাহ সমূহ মোচন হয়। যাকাত প্রদানের কারণে অর্থের অন্ধ মোহ হ্রাস পায়। অপচয় হতে মুক্ত থাকা যায় ও গরীব-দুঃখীদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করার মানসিকতা তৈরী হয়। ফলে দুনিয়াতে গড়ে ওঠে সুশীল ও সুন্দর সমাজ এবং পরকালে অর্জিত হয় জান্নাতের অফুরন্ত নে‘মত। আল্লাহ আমাদেরকে তা অর্জন করার তাওফীক্ব দিন। আমীন!